দলে যাদের জন্য কাজ করেছেন, তারাই বিট্রে করে চলে গিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল রোববার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ এর ঘটনার পরে আবার আওয়ামী লীগের ওপর যে আঘাত আসলো- তখন এটাই ধারণা করেছিল যে আওয়ামী লীগ আর কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এটাই ছিল সকলের পরিকল্পনা। যাই হোক, আমাকে নিয়ে আসা হয়। আমি চেষ্টা করেছি সংগঠন গোছাতে। আপনাদের মনে আছে এই সংগঠন গোছাতে কম কষ্ট করতে হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমি ৮১ সালে আসলাম, ৮৩ সালে একবার পার্টি ভাঙলো। এই ভাঙাটা আমার জন্য খুব ক্ষতিকর ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমার দুঃখ লাগে যে যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি আমি…আমার সঙ্গে যারা যখন যোগাযোগ করেছেন- আমি বাইরে থাকতে, ইন্ডিয়াতে থাকতে বা লন্ডনে থাকতে, যে তাদের সঙ্গে কাজ করবো। ১৯৭৯ সব আওয়ামী লীগ নেতারা সালে মুক্তি পাওয়ার পর নির্বাচনের প্রস্তুতি। ৮০ সালে লন্ডনে আমার সঙ্গে দেখা করেছে, আর ৭৯ সাল থেকে ইন্ডিয়াতে যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তখন সব সময় আমাকে জিজ্ঞেস করত- তখন আমি সব সময় যার কথা বলে দিতাম। তিনি যাতে দলটা চালাতে পারেন, তার কিছু ব্যবস্থাও আমি করে দিয়েছিলাম। যাদের জন্য করে দিয়েছি, আমি ফিরে আসার পর তারাই আমার সঙ্গে বিট্রে করে চলে গিয়েছে। এটা হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সব কিছু গুছিয়ে দিলাম, তখন আওয়ামী লীগের যারাই নেতা ছিলেন সবাই আমাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন। আমরা কাকে নিয়ে কাজ করবো, এত গ্রুপিং এর মধ্যে কোথায় যাবো? ৮২/৮২ সালে পার্টিটা ভেঙে চলে গেলেন। ঐ ভাঙনটা যদি না হতো তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগ ৮০ দশকে সরকার গঠন করতে পারতাম, নির্বাচন করে জয়ী হতে পারতাম। তখন আর এরশাদ ওভাবে মার্শাল ল দিয়ে ওভাবে গেড়ে বসতে পারতো না।’
তিনি বলেন, ‘এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা যখন আন্দোলন করি তখনো একটা ষড়যন্ত্র ছিল, এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল। আর আমার স্ট্যান্ড ছিল ‘‘নো’’, এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল না, আমরা গণতন্ত্র চাই। আমরা নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই। এর জন্য অনেক সমালোচনা সম্মুখীন আমাকে হতে হয়েছে এটা ঠিক। অনেকে অনেক কথা বলেছে, অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু আমি আমার বাবার কাছ থেকে যেটা শিখেছি যে যেটা নীতি হিসেবে জানবো, সেটা মেনে নিবো। সেখানে কে কি বললো সেটা বড় কথা না। আলটেমেটলি দেখা গেছে যে যেটা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা ঠিক ছিল। দলের ভেতরে বাইরে সমালোচনা অনেক কিছু ছিল; ভাঙন হলো। কারণ আমি তখন কেবল আসছি। কেবল আসার পর যখন এ রকম একটা ধাক্কা খেলাম। তারপর সারা বাংলাদেশ আমাকে ঘুরতে হয়েছে, সংগঠন তৈরি করতে হয়েছে। দিনের পর দিন মিটিং, রাতের পর রাত সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সংগঠনগুলোকে নতুন ভাবে তৃণমূল থেকে গড়ে তুলতে হয়েছিল। ওভাবে সংগঠন করে করে আজকে সংগঠনটা একটা পর্যায়ে এসে গেছে।’
স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ বেচে দিবে, আজান হবে না, মসজিদে উলু ধ্বনি হবে। এ রকম নানা অপপ্রচার কিন্তু করা হতো। সেগুলো আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে, জবাব দিতে হয়েছে। ’
৮০’র দশকে আওয়ামী লীগে ভাঙনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৮২ সালে রাজ্জাক সাহেব পার্টি ভেঙ্গে চলে গেল। এই যে মতিয়া আপা এখানে আছে, তার পাও ধরে ছিল যে আপনি পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। জলিল ভাই গিয়ে পা ধরে ছিল যে, পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। আমি নিজে বলেছিলাম যে আপনি পার্টি ভেঙে যাচ্ছেন কেন? রাজনীতি তো আপনার সঙ্গে করে আসছি। আপনি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, থকন আমি ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ভিপি হলাম। আপনি পার্টি ভাঙবেন কেন? উনি তখন বাকশাল করবেন এই বলে পার্টি ভাঙলেন। আর এই ভাঙাটা হলে গেল আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারপরও ৯১ সালে উনি আসলেন জোটের সঙ্গে নির্বাচন করতে। তাকে দুই সিট দিতে হবে। মাদারীপুর ও শরিয়তপুরে দুইটা সিট নিল, আর সব জায়গা একজন করে ক্যান্ডিডেট দাঁড় করায়ে দিয়ে, সেটা আবার কাঁচি মার্কা দিয়ে। মানে ঐ কাঁচি মার্কা আওয়ামী লীগের কাঁচি কাটা করা। ২/৪ হাজার করে ভোট কেটে নিল।’
তিনি বলেন, ‘জোটের মধে যদি বেঈমানি না হতো, নমিশনগুলো দিতে পারতাম তাহলে আমরা জয়ী হতে আসতে পারতাম। ভোট চলে গেল জোটে। তার মধে ৩৫টি সিট জোটকে দিয়ে দেওয়া হল। যাদের কোনো ভোটই নাই। নইলে আওয়ামী লীগের ভোট কখনো জামানাত বাজেয়াপ্ত হয় না। সেটাও হলো। এভাবে একটা হযবরল করে করা হলো। আপনারা জানেন একানব্বই সালে নির্বাচনের পর আমি পদত্যাপ করলাম, যে আমি করবো না। আমার যদি স্বাধীনতাটুকু না থাকে, নমিশন দিয়ে যদি জিততেই না পারি। তাহলে পদে থেকে লাভটা কী? আমি পদত্যাগ দিয়ে দিয়েছিলাম তখন। যাই হোক আমাদের নেতাকর্মী সবাই, কবি সুফিয়া কামাল আমাকে চিঠি লিখলেন যে- না তোমার এটা ছাড়া ঠিক হবে না। আমাদের পার্টির সবাই উঠে পড়ে লাগলো- যাই হোক আমি আবার দায়িত্ব নিলাম। ’
তিনি আরও বলেন, ‘তারপর থেকে চেষ্টা করলাম যে এবার নিজেদের মতো করে করবো। ৯৬ সালে সরকার গঠন করবো। এত বাধার পরেও আমরা আসতে পারলাম। ২০০১ সালে আসতে পারলাম না। ঐ গ্যাস বিক্রি নিয়ে আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ। আমি বললাম যে- দেশের স্বার্থ বিক্রি আমি করবো না। এটা আওয়ামী লীগের নীতি না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘২০০১ সালে হারার পর কোন কোন কেন্দ্রে আমরা হেরেছি তার একটা হিসেব করে আমাদের যত প্রার্থী ছিল- জেতা আর হারা না, যত প্রার্থী ছিল তাদের সঙ্গে বসি। দিনের পর দিন বসি। ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে এসে দশটা প্রশ্ন দিয়ে, কোয়েশ্চেন পেপার নিয়ে সায়েন্টিফিকেলি প্রস্তুতি নেই। যার ফলটা পেয়েছি ২০০৮ সালে।’
তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে অনেক লোক ঘুরে বেড়ায়, আর ভাল ভাল স্লোগান দেয়- আমি বড় নেতা, আমি জিতে যাবো নির্বাচনটা কিন্তু তা নয়। এটা আমি সব নেতাদের বলি। মনোনয়ন না পেলে মন খারাপ করেন, ঘটনা সেটা না। এটা কিন্তু অনেকের মতো হিসেব করে বের করা যায় কার পজিশন কী। আমরা এখন কিন্তু সেটাই করি। এবারের নির্বাচনে আমরা কিন্তু তাই করেছি।’