প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ এ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা (ধর্ষণ) রোধ করার ব্যাপক ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। আর সব থেকে বড় কথা মানুষের মাঝেও জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।’
সমসাময়িক কালে সামাজিক এই ব্যাধির প্রকোপ বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইদানিং ধর্ষণটা ব্যাপকভাবে হচ্ছে এবং প্রচারও হচ্ছে। এটার যত বেশি প্রচার হয় প্রাদুর্ভাবটাও তত বাড়ে।’
শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) ৭০ তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপনী এবং সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান সংযুক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। তাঁর সরকার ‘২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আজকের যারা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হলেন আপনারাই থাকবেন আগামী দিনের কর্নধার। আপনারাই দেশটাকে পরিচালনা করে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আজকের যাঁরা নতুন প্রজন্ম তাঁরই ’৪১ এর উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সৈনিক।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্ববাসী হয়েই আমাদের কর্মচারিরা দেশ এবং জনগণের সেবা করবে, সেটাই আমার লক্ষ্য। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ সকালে গণভবন থেকে সাভারস্থ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মূল অনুষ্ঠান স্থলসহ দেশের ৭টি বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সংযুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী ’৭৫ পরবর্তী সময়ে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলতে থাকার উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা চাই কোন ধরনের অন্যায়-অবিচার যেন না হয়। মানুষ যাতে ন্যায় বিচার পায়।’
তিনি বলেন, ‘মানুষের ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কারণ, আমি জানি যে, বিচার না পেলে কি কষ্ট। আমার বাবা-মা, ভাই, ভাতৃবধু-তাঁদেরকে যখন হত্যা করা হয়, খুনীদেরকে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। আমার বিচার চাওয়ার কোন অধিকার ছিল না। আমি কেন ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যাঁরা নিহত হয়েছিলেন তাঁদের পরিবারের কারোরই বিচার চাওয়ার কোন অধিকার ছিল না।’
তিনি বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আমার বাবা-মা, ভাই মারা গেছে আমি একটা মামলাও করতে পারিনি। আমার সেই অধিকারটাও ছিল না। এই সংস্কৃতি বাংলাদেশে যেন আর না থাকে। তাঁর সরকার ক্ষতায় আসতে পেরেছিল বলেই জাতির পিতার খুনী এবং দেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখ করেন তিনি।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
বিপিএটিসি’র রেক্টর মো. রাকিব হোসেন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ৭০ তম বুনিয়াদি কোর্সের ফলাফল হস্তান্তর করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অনুষ্ঠানে সনদ বিতরণ করেন।
এবারের ৬ মান ব্যাপী কোর্সটির শেষ একমাস করোনার কারণে অনলাইনে সমাপ্ত করা হয়। যেখানে ১৬১ জন নারীসহ ৬৬৩ জন প্রশিক্ষণার্থী অংশগ্রহণ করেন। এরমধ্যে ৫০ জন পুরুষ এবং ১৮ জন নারী সেন্টার অব এক্সিলেন্স সনদ প্রাপ্ত হন।
অনুষ্ঠানে সনদ প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পক্ষে মেহেদী হাসান কাওসার এবং মুনিয়া সিরাত নিজ নিজ অনুভূতি ব্যক্ত করে বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা দেশ স্বাধীন হবার পরই যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ পুণর্গঠনকালে সংস্কারের মাধ্যমে স্বাধীন দেশের উপযোগী সিভিল সার্ভিস গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
এ সময় সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে দেয়া জাতির পিতার একটি ভাষণেরও উদ্ধৃতি দেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতির পিতা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব কৃষক, আপনার মাইনা দেয় ঐ গরীব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়, ওদের সম্মান করে কথা বলেন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলেন, ওরাই মালিক।’
প্রধানমন্ত্রী এই উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘আজকে যারা নবীন কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের কিন্তু ঐ কথাটাই মনে রাখতে হবে যে, এই দেশের গরিব মানুষ যাঁরা বা এখনও তৃণমূলে যাঁরা পড়ে রয়েছেন তাঁরাই এদেশের মালিক। আর তাঁদের ঘর থেকেই লেখাপড়া শিখে আজকে উঠে এসেছেন। কাজেই, সেদিকে লক্ষ্য রেখে তাঁদের সেবা করাটাই হবে সব থেকে বড় দায়িত্ব।’
তিনি জাতির পিতার সিভিল সার্ভিস কমিশন সংস্কার নিয়ে আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস রি-অর্গানাইজেশন কমিটি’ ও গঠন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে জাতির পিতা তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে প্রত্যেক জেলার জন্য ‘জেলা গভর্নর’ নিযুক্ত করেন। কারণ, ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণই ছিল জাতির পিতার মূল লক্ষ্য।’
তিনি বলেন, কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না, কোন শিশুই পথশিশু থাকবে না, প্রত্যেক শিশুরই একটা ঠিকানা হবে এবং লেখাপড়া এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান করে জীবনে যাতে দাঁড়াতে পারে তার ব্যবস্থা আমাদের করে যেতে হবে।’
তিনি এ সময় সীমিত ভূখন্ড এবং বিশাল জনসংখ্যার উল্লেখ করে বলেন, ‘সেজন্যই তাঁর সরকারের লক্ষ্য প্রত্যেকটি গ্রামকে সকল ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শহরে রূপান্তরিত করা।’
সারা বাংলাদেশে তথ্য প্রযুক্তির সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিসের অন্তর্ভূক্ত করে ইউনিয়ন পর্যায়ে ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ডিজিটাল পোষ্ট অফিস নির্মাণ করে দেশকে ডিজিটালাইজড করে স্বাস্থ্যসেবাসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা জনগণের দোড়গোঁড়ায় নিয়ে আসায় তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের উল্লেখ করেন তিনি।
তাঁর সরকারের মানুষের নাগালের মধ্যে কম্পিউটার এবং মোবাইল ফোনকে নিয়ে আসার জন্য এসব পণ্যের ওপর থেকে আমদানী শুল্ক প্রত্যাহার এবং বেসরকারী খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়ারও তথ্য দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সেই চর কুকরি মুকরি থেকে শুরু করে সারাদেশ যেন ডিজিটাল সংযোগের আওতায় আসতে পারে সে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। কাজেই, দেশ ডিজিটাল হয়েছে বলে যেখানে করোনাভাইরাসের কারণে ঘর থেকেই বের হতে পারছি না সেখানে আপনাদের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কথা বলতে পারছি।’
তিনি বলেন, করোনাভাইরানের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর পরই আমি একটা নির্দেশ দিয়েছিলাম-আমাদের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতেই হবে। যে কারণে দেশে কোন খাদ্য সংকট হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির চাকা যেন সচল থাকে সে ব্যবস্থা যেমন আমাদের করতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশটা যেন এগিয়ে যেতে পারে সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
ভূমি সংস্কার ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজড করার ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ নামের ব-দ্বীপটাকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকটি জলাধার সুরক্ষা করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেন।
তাঁর সরকার প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধিকেও সমান গুরুত্ব দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নির্দেশনায় বিপিএটিসি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ভৌত অবকাঠামো পুনর্নিমাণ ও আনুষঙ্গিক সুবিধা সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিপিএটিসি’র সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ-শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
প্রশিক্ষণের আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি, আমাদের এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটা একদিকে যেমন দৃষ্টি নন্দন হয় এবং সেখানের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাটাও যেন বিশ্বমানের হয় এবং এখানে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা সমগ্র বিশ্বে যেন একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ‘আমি চাই এই কাজটা যেন একটু দ্রুত শেষ হয়,’ যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাশপাশি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে তাঁর একটি কাঠামো তৈরীতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ কওে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০১০ থেকে ২০২০ এখন আবার ২০২০ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করছি। এমনকি শতবর্ষ মেয়াদি ডেল্টা পরিকল্পনাও আমরা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।’
‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তিকে’ ধরে আরো রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সিভিল প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশকে এমন ভাবে গড়ে তুলবেন। এই বাংলাদেশ যেন আর কোনদিন পিছিয়ে না যায়।’
তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকটি মানুষের জীবনেই একটা দিক দর্শন থাকতে হয়। সুনির্দিষ্ট লক্ষ থাকতে হয়। লক্ষ্য বিহীন জাতি যেমন এগোতে পাওে না তেমনি দিকহারা জাতি কোন ঠিকানা খুঁজে পায় না। কাজেই, সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সকল পরিকল্পনা দিয়ে গেলাম। যাকে আপনারাই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’ পরিশেষে, করোনা ভাইরাসকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও সকলকে স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। -বাসস
তিনি বলেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে নিজে সুরক্ষিত থাকবেন এবং অপরকেও সুরক্ষিত রাখবেন।’