চলমান কাজসমূহের মূল্য সমন্বয় এবং নতুন রেট পাশের দাবি ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের

নির্মাণসামগ্রীর লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে চলমান কাজসমূহের মূল্য সমন্বয় এবং নতুন রেট সিডিউলের বিষয়ে করণীয় নিয়ে মতবিনিময় ও নীতিনির্ধারণী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের আয়োজনে।

রবিবার ( ১৭ এপ্রিল) দুপুর ৩টায় রাজধানীর
গুলশান ১ অবস্থিত অল কমিউনিটি ক্লাবে এ মতবিনিময় ও নীতিনির্ধারণী সভা এবং ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সভাপতি রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ম. আবদুর রাজ্জাকের সঞ্চারনায় প্রায় ২শতাধিক ঠিকাদার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।

ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, উন্নয়ন বান্ধব বর্তমান সরকারের দূরদর্শিতা এবং কার্যকরি পদক্ষেপ সমূহের কারণে বিশ্ব দরবারে আমরা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কাতারে আসীন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঠিক ও সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমিকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানোর জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। ।সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসাবে ঠিকাদাররা সাফল্যের সাথে বাস্তবায়ন করে আসছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সময়মত বাস্তবায়ন না হলে দেশের উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রন্থ হবে। চলমান ভয়ানক সংক্রামক কোভিড-১৯ এর কারণে আমরা ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। এর মধ্যে অত্যন্ত পরিতাপ ও দুঃখের বিষয় এই যে, বিগত ১ বৎসরের অধিক সময় ধরে নির্মাণ প্রকল্পের মূল উপকরণ সমূহ যেমন- লৌহ এবং লৌহ জাতীয় দ্রব্য, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, ডিজেল, এ্যালুমিনিয়াম, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেম ইত্যাদি দ্রব্যাদি সহ এ খাতের প্রায় সকল প্রকার নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক ও লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়ে অসহনীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। প্রতিটন রডের বর্তমান মূল্য ৯০,০০০ টাকা থেকে ৯৫,০০০ টাকা, যা ২০২১ সালের মার্চ মাসে ছিল ৫৫,০০০ টাকা থেকে ৬০,০০০ টাকা। অর্থাৎ শতকরা বৃদ্ধির হার ৬০% এর অধিক। পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেক্ট্রো ম্যাকানিক্যাল দ্রব্য সমূহের মূল্যও ৪০% – ৯৪% এর অধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও এ শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিক, সুপারভাইজার ও দক্ষ জনবলের মজুরীও শতকরা ৬০-৭০% বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকার স্থলে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ টাকা হওয়ার ফলে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও যন্ত্রপাতি চালনা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানিকৃত সকল নির্মাণ মালামালের ও যন্ত্রপাতির মূল্যও ক্রমান্বয়ে আশংকাজনক-ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ছাড়াও নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ বিল চুক্তিকৃত রেট এর সাথে সন্নিবেশিত না থাকায় ঠিকাদারকে তা পরিশোধ করতে হয়। গত অর্থ বছরে দরপত্র দাখিলের সময় ৫% হারে এআইটি ধার্য ছিল এখন তা ৭% করা হয়েছে এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অগ্রগতিতে অতি মন্থরতা দেখা দিয়েছে, বাস্তব অগ্রগতি খুবই হাতাশাব্যঞ্জক। কাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার ফলে ঠিকাদারগণ বিল পাচ্ছেন না। ফলে গৃহীত ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করাও তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বিধায় ব্যাংক হতে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে এবং ঠিকাদারগণের আর্থিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রীর সীমাহীন অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে ঠিকাদারগণ মারাত্মকভাবে আর্থিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা চলমান প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না এবং নূতন কোন দরপত্রেও অংশ গ্রহণ করার সাহস পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় চলমান অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির সাথে মূল্য সমন্বয় না করলে সকল নির্মাণ কাজে স্থবিরতা দেখা দিবে এবং প্রকল্প বান্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এমন পরিস্থিতিতে মতবিনিময় ও ইফতার মাহফিল থেকে সরকারের প্রতি ঠিকাদারদের পক্ষে কিছু সুপারিশ জানানো হয়। সুপারিশ গুলো হলো:

১. বর্তমান চলমান কাজ গুলো যেহেতু Fixed Rate Contract এ সম্পাদিত হচ্ছে; তাই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রজ্ঞাপন জারী করে PPR এ সন্নিবেশিত ফরমূলা অনুযায়ী Price Adjustment ধারা সকল চুক্তিতে অন্তর্ভূক্ত করা হউক।

২. এখন থেকে প্রতিটি দরপত্রে কাজ বাস্তবায়নের সময় বিবেচনা ব্যতিরেকে পিপিআর অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় মূল্য সমন্বয় ধারা (Price Adjustment Clause) নিবেশিত করে কার্যকর করণ সহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারী, অজ্ঞতা প্রসূত এবং পিপিআর ২০০৮ (সংশোধিত ২০১০) এর সহিত সাংঘর্ষিক আরোপিত শর্তাবলী দরপত্রে প্রদান থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হউক।

৩. বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী PWD সহ সকল দপ্তরের Rate Schedule হালনাগাদ করা হউক।

৪. প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ সকল Rate Schedule এ সন্নিবেশিত করা হউক।

৫. বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ববাজার পরিস্থতিতে, বৈশ্বিক অর্থ মন্দার প্রভাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির বিপরীতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে Price Contingency এর আওতায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হউক।

৬. সরকারের পরিপত্র ও বিধি নিষেধ আরোপের কারনে নির্মাণ সামগ্রীর দরের পরিবর্তনের প্রভাব এবং নির্মাণ ব্যয় সমন্বয় সংক্রান্ত পিপিআর এ বর্ণিত ধারা “Adjustment for changes in legislation” কার্যকরী করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্তৃক উন্নয়ন কাজে নিয়োজিত নির্বাহী প্রতিষ্ঠানকে জরুরী আদেশ প্রদান করা হউক।

৭. আমদানী নির্ভর নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচা মালের আমদানী শুল্ক সাময়িক ভাবে হলেও স্থগিত করা হউক।

৮. চলমান নির্মাণ চুক্তি গুলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন উন্নয়ন নির্বাহী প্রতিষ্ঠান যেমন- গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি মূল্য সংশোধন সেল তৈরী পূর্বক চুক্তিবদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হউক।

৯.চলমান কাজে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির জন্য যে ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতির জন্য compensation দেওয়া হোক।

১০.বর্তমান আরোপিত AIT ৭ শতাংশ এর পরিবর্তে ২ শতাংশ এবং VAT ৭.৫ শতাংশের পরিবর্তে ২ শতাংশ করা হোক।

মতবিনিময় সভা ও ইফতারে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সভাপতি ‘কুশলী নির্মাতা’র ব্যবস্থাপনা প‌রিচালক রফিকুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ‘তাজওয়ার ট্রেড সি‌স্টেম’র ব্যস্থাপনা প‌রিচালক ম. আব্দুর রাজ্জাক, স্পেক্টা কনস্ট্রাকশনের নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মমতাজ উদ্দিন, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বশির আহমেদ, এস এস রহমান গ্রুপের চেয়ারম্যান রকিবুল আলম দিপু, এন এন বিল্ডার্সের মালিক ফরিদ উদ্দিন রতন সহ দেশের নামকরা সকল ঠিকাদারি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও মনোনীত প্রতিনিধিরা।