সৌরভ শীল, চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ):
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রাম বাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া – ঘেরা শান্তির নীড় মাটির তৈরি ঘর বিলুপ্তির পথে। সচরাচর আর দেখা যায় না, এমন সুন্দর মাটির তৈরি এই ঘরগুলি। এক সময়ের মনোমুগ্ধকর বসবাসে মানুষের কাছে মাটির ঘর গরিবের এসি ঘর হিসাবে বেশ পরিচিত এই শান্তিরনীড় মাটির ঘর কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। ইট, বালু ও সিমেন্টের প্রাচীরঘেরা দুর্গে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই মাটির ঘরের কথা এখন আর কারও মনিকোঠায় নেই।
পাহাড়ি ঘেঁষা এই উপজেলার দশটি ইউনিয়নে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর গ্রাম বাংলার প্রাচীনকাল থেকেই মাটির ঘরের প্রচলন ছিল, তা এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এসব মাটির ঘর তৈরি হতো এঁটেল বা আঠালো মাটি কাঁদায় পরিনত করে, খড় বা টিন দিয়ে উপরে ছাউনি দেয়া হতো। এক সময় খড় – ছনের ছাউনিই ছিল বেশি। বাপ -দাদার তৈরি করা মাটির ঘর সংস্কার করে কোনো কোনো স্থানে উপরে টিন ব্যবহার করা হচ্ছে৷
আলীনগর গ্রামের আব্দুর রহিম (৫৫) বলেন, আমাদের বাড়িতে সাত পরিবারের বসবাস। দেড় দশক (১৫ বছর) আগেও আমাদের বাড়ির প্রতিটা ঘর মাটির ছিল। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বাড়ির প্রতিটা ঘর পাকা বিল্ডিং হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, যতোই বিল্ডিং আর অট্টালিকায় থাকিনা কেন, মাটির ঘরে থাকার মতো যে স্বাচ্ছন্দ আর তৃপ্তিদায়ক ছিল সেটা এখন আর পাই না। ছন বাঁশের ছাউনির মাটির ঘরে প্রাকৃতিক এয়ারকন্ডিশন হিসাবেই পরিচিত। প্রচন্ড গরমে আরাম দায়ক এই মাটির ঘরে বসবাস করলেও অন্যরকম শান্তির অনুভূতি পাওয়া যেত। শারীরিকভাবে সুস্থতায় থাকতো মানুষেরা। এখন প্রত্যেকটা গ্রাম ঘুরেও একটা মাটির ঘর খোঁজে পাওয়া যাবে না । দিন দিন মানুষ বড় বড় দালান কোঠায় বসবাস করে, প্রাকৃতিক এই শান্তির নিবাস মাটির ঘর ভুলে গেছে।
এদিকে, উপজেলার সাতছড়ি, রেমা – কালেঙ্গা, আমু, নালুয়া, চান্দপুর, বেগমখান, চন্ডি, লস্করপুর, দেউন্দী, লালাচান্দসহ বিভিন্ন চা বাগানে কিছু কিছু মাটির ঘর এখনো দেখা যায়। এসব এলাকায় বসবাসরত বাঙালী, ত্রিপুরা, সাঁওতাল ও চা শ্রমিকেরা জানান, প্রচন্ড গরম ও শীতে বসবাসের উপযোগী ছিল এই মাটির ঘর। ধনী – গরিব সবাই সেই মাটির ঘরে বসবাস করতেন। তবে কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্ত হতে বসেছে মাটি দিয়ে তৈরি ঘর। ছন আর বাঁশের ছাউনিতে মাটির ঘর প্রাকৃতিক শান্তির নিবাস, আরাম দায়ক মনে করে এলাকার বাসিন্দারা। তাই এসব এলাকার কিছু কিছু পরিবার বাপ -দাদার তৈরি মাটির ঘর সংস্কার করে এখনো ধরে রেখেছেন।
লস্করপুর চা-বাগানের সমীর পাইনকা বলেন, আমার ঠাকুরদাদু প্রায় ৬০/৭০ বছর আগে মাটির একটি ঘর নির্মাণ করেছিলেন। তখনকার সময়ে এই ঘরটি নির্মাণ করতে প্রায় ৫/৬ হাজার টাকা খরচ হয়। এখন এই ধরনের ঘর তৈরি করতে প্রায় ৩০/৪০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় আরাম দায়ক মাটির ঘর হারিয়ে যাচ্ছে। চান্দপুর চা-বাগানের মেম্বার নৃপেন পাল বলেন, এই উপজেলার বিভিন্ন চা বাগানে এখনো অনেক মাটির ঘর রয়েছে। বাপ – দাদার তৈরি করা এই মাটির ঘর প্রতি বছর কিছুটা মাটি দিয়ে সংস্কার করে আজও বসবাস করছেন।
চুনারুঘাট পৌরসভার বড়াইল গ্রামের বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক বাবুল চন্দ্র শীল বলেন, মাটির ঘর শুধু শান্তিই ছিলোনা, ছিল গ্রাম বাংলার শিল্প, ঐতিহ্য ও সুন্দর্য্য। নিত্যনতুন আকর্ষণ ইট, বালু, সিমেন্টের তৈরি বিল্ডিংয়ের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শান্তির নীড় নিদর্শন এই মাটির ঘর।