আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের কোটি কোটি মানুষের আনন্দের উৎস। বিনোদন, শিক্ষা ও স্বপ্ন বিস্তারের সবচেয়ে বড় একটি মাধ্যম। তাই চলচ্চিত্র আমাদের গর্ব। চলচ্চিত্র আমাদের প্রেরণা, আমাদের জীবনের সহযাত্রী। চলচ্চিত্র মাটি ও মানুষের কথা বলে, মানুষের আজন্ম লালিত সাধ ও স্বপ্নকে সেলুলয়েডে বন্দী করে পর্দায় নানা রঙে ফুটিয়ে তোলে।
জাতীয় চলচ্চিত্র দিবসে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা, রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার হাত ধরে স্বাধীনতা পেয়েছি এবং চলচ্চিত্র তার যাত্রা শুরু করেছে। ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিল উত্থাপনের মধ্য দিয়ে এই মহান দূরদর্শী নেতা জন্ম দেন চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের। আর সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন চলচ্চিত্র দিবস ও চলচ্চিত্রকে শিল্প ঘোষণা করেছেন, তেমনি ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় চলচ্চিত্রকেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরের নির্দেশনা দিয়ে এই মাধ্যমকে যুক্ত করেছেন নূতন অভিযাত্রায়।
এ মুহূর্তে আমি প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, তারেক মাসুদ, হুমায়ূন আহমেদ, চাষী নজরুল ইসলাম, সুভাষ দত্ত, এহতেশাম, শহীদুল ইসলাম খোকন, চলচ্চিত্রকার খালিদ মাহমুদ মিঠু, অভিনয় শিল্পী সুমিতা দেবী, হুমায়ূন ফরিদী, রোজী আফসারী, মান্না, সালমান শাহ, দিতি, চলচ্চিত্র সাংবাদিক হারুনুর রশীদ, আওলাদ হোসেনসহ সকল প্রয়াত ও বর্তমান শিল্পী, পরিচালক, প্রযোজক, নির্মাতা, কলাকুশলী ও চলচ্চিত্র সাংবাদিক যাদের কর্মে এ রূপালী জগত উদ্ভাসিত, তাদের সকলকে আমার অকুন্ঠ আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি। সেইসাথে সকল চলচ্চিত্র গবেষক, বোদ্ধা, আলোচক-সমালোচকদেরও আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা, তাদের শাণিত মেধা দিয়ে এ বিশাল জগতের উন্নয়নকল্পে এগিয়ে আসার জন্য।
আজকের দিনটি আরো একটি বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়া আজ মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন হয়েছে। আমরা গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার যে নিরলস পরিশ্রমে রত, এটি তারই আরেকটি বাস্তব উদাহরণ। আমাদের সচিব মরতুজা আহমদসহ যে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এ খসড়া প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের আমি আবারও আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
আপনারা জানেন, চলচ্চিত্রের সংজ্ঞা একেক জন একক ভাবে দিয়ে থাকেন।
-সত্যজিৎ রায় বলেন, ‘ফিল্ম হলো ছবি। ফিল্ম শব্দের মধ্যে গতি আছে। রয়েছে নাটক, সঙ্গীত, গল্প।
-মৃণাল সেন বলেন, চলচ্চিত্র আর কিছুই নয়- অসংখ্য স্থির চিত্রের সমাবেশমাত্র। এক সেকেন্ড পরপর ২৪টি স্থিরচিত্র পড়ছে।’
-আর রবিঠাকুর সেই ১৯২৯ সালে বলেছেন, ‘চলচ্চিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতিপ্রবাহ। আসলে চলচ্চিত্রের সৃষ্টি হয়েছে জীবনের কথা বলার জন্য। সর্বকলা আত্মীকৃত এক শিল্প, যোগাযোগ ও প্রকাশমাধ্যম এই চলচ্চিত্র।’
আমি বলি, চলচ্চিত্র
-জীবনের জন্য -আনন্দের জন্য।
-মুগ্ধতার জন্য -সৃষ্টির জন্য -শেখার জন্য -শেখাবার জন্য।
-জানার জন্য -কল্পনার জন্য -অতীত জানার জন্য -ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য।
-সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির জন্য -সুশাসনের জন্য -বৈষম্য দূর করার জন্য।
-শান্তির জন্য -উন্নয়নের জন্য -বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবার জন্য।
রবিঠাকুর বলেছেন, কমলহীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে, আর ওর থেকে যে আলো টিকরে পড়ে, তাকেই বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি। চলচ্চিত্র সেই দীপ্তি ছড়ায়- আমাদের জীবনকে আলোকিত করে।
আমি নিরপেক্ষ নই। আমার পক্ষ আছে। আমি মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে। টেকসই সবুজ ডিজিটাল বৈষম্যহীন উন্নয়নের পক্ষে। অবাধ তথ্যপ্রবাহ আর গণমাধ্যমের সুস্থ-স্বাধীন বিকাশের পক্ষে। আর তাই আমি যুদ্ধাপরাধ-জঙ্গিবাদ-সাম্প্রদা য়িকতা-আগুনযুদ্ধের বিপক্ষে। আমি আপনাদের মতো তারকা নই, শিল্পী নই। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি। জঙ্গির আক্রমণে ভয় পেলে সভ্যতার পরাজয় হবে। ভড়কে না যেয়ে লেখালেখি, সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে। উগ্রবাদিরা সভ্যতার জঘন্য শত্রু, বাংলাদেশেরও। জঙ্গিরা শেকড় কাটে। চলচ্চিত্র শেকড়ের সংগে পরিচয় করিয়ে দেয়, সাম্প্রদায়িকতা-কুসংস্কারের আবর্জনা পরিস্কারে শক্তি দেয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিদমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সেই সাথে আছে নিজশক্তিতে উন্নয়নের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি বর্জন করে আইনের শাসনের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ ও সংকল্প ফুটে উঠেছে তার নেতৃত্বে। আরেক ধাপ উঠবেই দেশ।
প্রশ্ন হচ্ছে-
-ইতিহাসের ডাস্টবিন বুকে নিয়ে কি আরেক ধাপ ওঠা যাবে!
-অগণতান্ত্রিক শক্তি ও অপরাধীদের রাজনীতির ময়দানে রেখে কি আরেক ধাপ ওঠা যাবে!
-নারীদের পেছনে রেখে কি আরেক ধাপ ওঠা যাবে!
-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির দক্ষতা ছাড়া কি আরেক ধাপ ওঠা যাবে!
-কেবল জঙ্গিদমন করে, জঙ্গি-পাহারাদার-পৃষ্ঠপোষকদের দমন না করে কি আরেক ধাপ ওঠা যাবে!
-আরেক ধাপ ওঠার জন্য কোন্ পথে যাবে বাংলাদেশ! পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পথে! নাকি নিজের পথে!
আমি বলি, বাংলাদেশ বাংলাদেশের পথেই যাবে। বাংলাদেশের পথ হচ্ছে-
-আউল-বাউলের পথ। লালন-হাসন রাজার পথ।
-রবীন্দ্র-নজরুলের পথ। শামসুর রাহমান-হুমায়ূনের পথ।
-ঈদ, পুজো, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিনের পথ।
-বায়ান্ন আর একাত্তরের বীর শহীদানদের দেখানো পথ।
-মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পথ।
-টেকসই সবুজ ডিজিটাল বৈষম্যহীন উন্নয়নের পথ। আর,
-বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ।
আর এই পথে একা হাঁটা যায়না। সবাইকে এক সাথে হাঁটতে হয়। চলচ্চিত্রকার, লেখক, কবি, গায়ক, সুরকার, যন্ত্রী, চিত্রকর, ভাস্কর, রাজনীতিক- সবাইকে একসাথে হাঁটতে হবে বাংলাদেশের পথে।
সেই বাংলাদেশকে আরেক ধাপ ওপরে তুলতে হবে, যেখানে শান্তি-সমৃদ্ধি-সুশাসন থাকবে। তার জন্য চাই তিন যুদ্ধ-
-জঙ্গি-উৎপাত দমনের যুদ্ধ।
-নিজশক্তিতে বৈষম্যমুক্ত উন্নয়নের যুদ্ধ।
-দুর্নীতি-দলবাজি দূর করার যুদ্ধ।
এ তিন যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ শান্তির দেশ হবে, সমৃদ্ধির দেশ হবে, সুশাসনের দেশ হবে।
শিল্পী-সংস্কৃতিসেবীদের দায়িত্ব অনেক বড়। রাজনীতিকরা ভুল করতে পারে, আপোষ করতে পারে, আপনারা পারেননা। স্বৈর-সাম্প্রদায়িক শাসকরা ক্ষমতার জন্য জামাতী-যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুণর্বাসিত করেছিল, এদের পক্ষে ওকালতিও করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের মহিমান্বিত করে কখনো কোনো সিনেমা হয়নি আজ অবধি, কোনো গান বা কবিতা হয়নি, হয়নি কোনো উপন্যাস।
তাই চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি জগতের মানুষদের আমি সালাম জানাই। শ্রদ্ধা করি। তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বীরদের নিয়ে, দেশ ও মানুষ নিয়ে ভাবেন- কাজ করেন- আমাদের পথ দেখান। জেনে রাখবেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাদের সাথে রয়েছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজ দেশে-বিদেশে সমাদৃত। ‘মুখ ও মুখোশ’ থেকে যে দেশের চলচ্চিত্রের অভিযাত্রা প্রতিযোগিতার মধ্যেই টিকে আছে- আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের বাজধানী ঢাকা হবে ৩৫ কোটি বাংলাভাষাভাষী মানুষের চলচ্চিত্রের রাজধানী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এগিয়ে চলেছে এক নতুন গন্তব্যে। আমাদের লক্ষ্য সুখী-সমৃদ্ধিশালী, দেশপ্রেমে সমুজ্জ্বল, মানবিক মূল্যবোধে উদ্দীপ্ত সবুজ, টেকসই আধুনিক ‘ডিজিটাল সোনার বাংলা’, যার অস্তিত্বের সাথে অঙ্গীভূত হবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র।
জাতীয় চলচ্চিত্র দিবস হোক আমাদের নূতন দিনের প্রেরণা। কথা নয়, কাজ দিয়েই আমরা প্রমাণ করবো, চলচ্চিত্রে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে-সোনালী গন্তব্যে পৌঁছুবেই।
লেখকঃ মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু