প্রো-রেসলিং এর অন্তরালের গল্প

প্রো-রেসলিং এর অন্তরালের গল্প

রেসলিং নিয়ে আপনার মনে কিছু প্রশ্ন আসতে পারে। রিং এর আছাড়ে কি আদপে কোনো ব্যাথাই লাগে না? চেয়ারের আঘাত কিংবা ট্রিপল এইচের স্লেজহ্যামার কি নকল? ব্রক লেসনারের ঘুষির আঘাতে জন সিনার কপালের রক্ত কি কিছুই না? আন্ডারটেকার যদি ডেডম্যান না হয় তাহলে রিং এ হঠাৎ করে রিং এ চলে আসে কিভাবে? সেরকম কিছু প্রশ্নের উত্তরই দেওয়া হলো আজকের এ লেখায়।

রিং

রেসলিং রিংগুলো মূলত কাঠ দিয়ে তৈরি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফাঁপা স্টিলও ব্যবহার করা হয়। রেসলারদের সুবিধার জন্য এর উপর থাকে কয়েক স্তরের হালকা, ফ্লেক্সিবল ফোম যা রেসলারদেরকে চরম আঘাত থেকে রক্ষা করে। এছাড়া রিং-এর নিচের একেবারে মাঝখানে থাকে বিশাল সাইজের স্প্রিং যা একই সাথে রেসলারদের পতনের আঘাতকে কমিয়ে দেয় এবং রেসলারদেরকে লাফ দেওয়ার সুবিধা প্রদান করে। রিং-এর দড়িগুলো তৈরি করা হয় স্থিতিস্থাপক তার দিয়ে এবং এর উপর থাকে কয়েক স্তরের ফোম। তারপর ফোমের উপর রংবেরং-এর টেপ লাগিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। রিং-এর চারকোণার বিমগুলো তৈরি করা হয় পাতলা স্টিল দিয়ে। দড়ি আর বিমের সংযোগরক্ষাকারী টার্নবাকলগুলোর উপর থাকে পুরু ফোম, যা একইসাথে স্ক্রুগুলোকে ঢেকে রাখে আর রেসলারদেরকে আঘাত থেকে রক্ষা করে।

রিং এর গল্প এখানেই শেষ নয়। রিং-এর নিচে থাকে গোপন স্পিকার যা সামান্য শব্দকে অ্যামপ্লিফাই করে পুরো অ্যারেনায় ছড়িয়ে দেয় এবং দর্শকদের কাছে আছাড়গুলোকে আরও আসল বলে মনে হয়! “খালি কলসি বাজে বেশি”-এর আদর্শ উদাহরণ রেসলিং রিং।

এন্ট্র্যান্সের সময় সিন কারা কিভাবে এত উঁচুতে লাফ দেয়? রহস্য লুকিয়ে রয়েছে রিং এর সামনের নরম ম্যাটে। ম্যাটটা আর কিছুই নয়, একটা সহজ সরল ট্র্যাম্পোলিন! সিন কারা লাফ দেওয়ার সময় ট্র্যাম্পোলিনটা কাজ করে স্প্রিং-এর মতো। ফলে সৃষ্টি হয় অসাধারণ চমকপ্রদ এক এন্ট্র্যান্সের। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে ট্র্যাম্পোলিনটা গায়েব হয়ে যায় রিং এর নিচে থাকা স্টাফদের সহায়তায়, অন্তত টিভির দর্শকদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে হবে তো!

আন্ডারটেকারের ভোজবাজির মতো উদয় হওয়ার রহস্যও লুকিয়ে থাকে রিং এর মধ্যেই। রিং এর নিচের গোপন প্যাসেজ দিয়ে সহজেই চলাচল করে আন্ডারটেকার তার ডেডম্যান গিমিকটা আরও ভালভাবে ফুটিয়ে তোলেন, সাথে লাইট অফ হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই রেসলারকে দুই-তিনখানা চড় মেরে আবার গায়েব হয়ে যান!

Resling

অস্ত্র

প্রো-রেসলিং-এ বিভিন্ন  ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় “টিএলসি” খ্যাত টেবিল-ল্যাডার-চেয়ার।

টেবিলঃ টেবিল বানানো হয় পাতলা প্লাইউড বা হার্ডবোর্ড দিয়ে যা খুব কম ওজনেই ভেঙে পড়ে যায়। আর এজন্য টেবিলের মধ্যভাগ তথা সবচেয়ে দুর্বল জায়গাকে বেছে নেওয়া হয় রেসলারদেরকে আছাড় মারার জন্য।

চেয়ারঃ  চেয়ারগুলো বানানো হয় হালকা ধাতু দিয়ে যেগুলো অল্প আঘাতেই অধিক শব্দের সৃষ্টি করে। গুজব রয়েছে, শব্দের মাত্রা বৃদ্ধি করার জন্য চেয়ারে ছোট মাইক্রোফোনও ব্যবহার করা হয়, তবে কথার সত্যতা যাচাই করা কঠিনই। চেয়ারশটে বেশ ভালোরকমই ব্যাথা অনুভূত হয়। চেয়ার ব্যবহারে খুব একটা টেকনিক খাটানো হয় না, তবে রেসলারদেরকে চেয়ারের আঘাত সহ্য করার জন্য প্রচুর অনুশীলন করতে হয়, সাথে শারীরিকভাবেও প্রস্তুত থাকতে হয়।

স্লেজহ্যামারঃ  স্লেজহ্যামার ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন ট্রিপল এইচ। হাতুড়িটি একেবারে আসল হওয়ায় এটি ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু টেকনিক অবলম্বন করতে হয়। আঘাত করার সময় হাতুড়ির ধাতব অংশের সামনে হাত দিয়ে রাখা হয়, যাতে প্রতিপক্ষের গায়ে সরাসরি আঘাত না লাগে। সাধারণত হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয় না, করা হয় পেট বা মুখে।

রেফারি

একটা রেসলিং ম্যাচে রেফারির কাজ কী যখন ম্যাচের ফলাফল আগে থেকেই সাজানো? একটা রেসলিং ম্যাচে রেফারিও রেসলারের মতো গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, রেফারিরা রেসলারদের যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কিভাবে? যখন কোনো রেসলার রেসলিং-এর নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রতিপক্ষকে মারতে থাকে, তখন রেফারি চিৎকার করে রেসলারকে থামতে বলেন। শুধু কি থামতেই বলেন? না, বরং রেসলারদেরকে এটাও বলেও দেন যে এরপর কোন মুভটি ব্যবহার করতে হবে! আর ব্যাকস্টেজ থেকে তার কানে থাকা ইয়ারপিসে অবিরত সংকেত আসে ম্যাচটিকে কোনদিকে এগিয়ে নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, তাদেরকে “ব্লাইন্ড আই” এর ভূমিকা পালন করতে হয়। ফেস রেসলারদেরকে ঠেকানোর অভিনয় করে হিল রেসলারদের অবৈধভাবে মারার সুযোগ করে দিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরানোতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে রেফারি। এছাড়াও স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী রেসলারদের ধাক্কা খেয়ে কিছুক্ষণ অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করা আর ঠিক সময়মতো ভোজবাজির মত আবার সুস্থ হয়ে গিয়ে পিন করাও রেফারির কাজ।

অনেক সময় দেখা যায় রেসলারদের শরীর কেটে রক্ত বের হচ্ছে, তবে সেটা বেশিরভাগ সময় কপালই হয়। কপাল এমন একটা জায়গা যেখানে সামান্য আঘাতেই ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়। এ কারণে রেসলাররা ব্লাডি ম্যাচের রক্ত আমদানি করার জন্য কপালকেই বেছে নেন। ২০০৯ সালের আগের ম্যাচগুলোর রক্তপাতগুলোগুলো ছিল আসল, রেসলাররা নিজেদের কপাল ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলতেন। এই ছোট ব্লেডকে বলা হয় গিগ। ব্লেডের ক্ষত ২-৩ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে গেলেও বেশ কয়েকবছর আগে WWE-তে ব্লেড ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়।

কিন্তু ম্যাচের আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য তো রক্তপাত প্রয়োজন। তবে? এর পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যবহার শুরু হল ব্লাড ক্যাপস্যুলের। ব্লাড ক্যাপসুল যেমন শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করবে না, তেমনিভাবে বেশ বড় ধরণের রক্তপাতও ঘটানো সম্ভব। অর্থাৎ এক্সট্রিম রুলসে ব্রক লেসনারের ঘুষির আঘাতে জন সিনার কপাল মোটেই ফাটেনি, বরং ফেটেছে বেশ বড় সাইজের একটা ব্লাড ক্যাপস্যুল!

প্রশ্ন হচ্ছে রেফারির ভূমিকা কি? রেসলাররা নিশ্চয় নিজেদের আন্ডারওয়ারের মধ্যে ব্লাড ক্যাপস্যুল আর ব্লেড নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না! দর্শকদের অলক্ষ্যে রেফারিকেই এগুলো সরবরাহ করতে হয়।

টিভি ব্রডকাস্ট

WWE এর মতো বড় মাপের প্রো-রেসলিং কোম্পানিরা ক্যামেরার পিছনে বিশাল অংকের টাকা খরচ করে, এর কারণও আছে যথেষ্ট। লাইভ শো টেলিকাস্ট করার সময় রিং এর আশেপাশে প্রচুর ক্যামেরাম্যান ছড়িয়ে থাকে। আর প্রোমো কাটের সময় রেসলাররা সবসময় মেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলেন, কারণ তাদেরকে এভাবেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ক্যামেরাম্যানরা এমন অ্যাঙ্গেল থেকে ভিডিও করেন যেন রেসলারদের মুভ কল করা দেখা না যায়। ম্যাচ খেলার সময় রেসলারদের পরামর্শ দর্শকরা দেখতে পেলে তো সমস্যা, তাই যখনই কোনো ক্যামেরায় রেসলারদেরকে মুভ কল করতে দেখা যায়, তখনই সেই ক্যামেরা পরিবর্তন করে অন্য ক্যামেরা থেকে টেলিকাস্ট করা হয়।

র, স্ম্যাকডাউন ছাড়া অন্যান্য যেসকল শো লাইভ দেখানো হয় না (সুপারস্টারস, মেইন ইভেন্ট ইত্যাদি) সেগুলোতে পরে অডিও যোগ করা হয়। যেমন- হঠাত দেখা গেল কোনো রেসলার এন্ট্র্যান্স করল, দর্শকদের চিৎকারও প্রচুর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু দর্শকদের মুখ খুব একটা নড়তে দেখা যাচ্ছে না। এরকম ক্ষেত্রে অডিও যোগ করা হয়। অনেক সময় লাইভ টেলিকাস্টের আগেই অডিও তৈরি করে রাখা হয় লাইভ শো চলাকালীন সময়ে টিভির দর্শকদের জন্য!

এত গোপন তথ্য জানার পর আপনার মনে হতে পারে তাহলে এত লোকজন রেসলিং পয়সা খরচ করে দেখতে আসে কেন? উত্তর একটাই, বিনোদন। রেসলাররা ৫-১০ বছর ট্রেনিং নিয়ে, সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেদেরকে প্রস্তুত করে আপনাকে বিনোদন দেওয়ার জন্যই। আর খুব বড় মাপের তারকা না হলে তার আয় খুবই যৎসামান্য। সেই আয়টুকু করতে গিয়েই তাকে চেয়ারের বাড়ি খেতে হয়, দশ ফুট উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়, এমনকি ভয়াবহ আঘাত নিয়েও হাসপাতালে পড়ে থাকতে হয় ৩-৪ মাস!

পরে হয়ত রেসলিং-এর আরও গোপন ঘটনা আপনাদের সামনে হাজির হবে। ততদিন পর্যন্ত রেসলিং খেলাটিকে উপভোগ করুন, রেসলারদের কষ্টকে সম্মান দিতে শিখুন। তথাস্তু প্রো-রেসলিং এর সাথে MMA, UFC বা আসল কুস্তিকে গুলিয়ে ফেলবেন না। তথ্যসূত্রঃroar.media