ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্র ও প্রস্তুতি

ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্র ও প্রস্তুতি

একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ব্যাংকের অবদান অপরিসীম। ইংরেজীতে একটা কথা আছে, ‘The economic structure of a country depends on the banking system of the country’- অর্থাৎ ব্যাংক-ব্যবস্থার ওপর একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ভর করে।। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পূর্ব থেকেই ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ‘বিশেষায়িত ব্যাংক’, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক’ ও ‘প্রাইভেট ব্যাংক’। প্রতিযোগিতার এই যুগে ব্যাংকসমূহের মোট সংখ্যা ৫৫ ছাড়িয়েছে, এবং প্রত্যেক বছরই ব্যাংকগুলোর শাখা বিস্তৃত হচ্ছে। ব্যাংকের চৌকস বেতন-ভাতাদি, সুযোগ-সুবিধা, চাকুরির নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদা থাকার কারণে এ পেশার প্রতি তরুণদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

ব্যাংকের কাজ

‘ব্যাংকের প্রধান কাজই হলো আমানত সংগ্রহ করা এবং সেই সংগৃহীত অর্থ ঋণস্বরূপ প্রদান করা’। এই সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, একটি ব্যাংক মূলত আমানত গ্রহণ, ঋণ দান, এবং চেক প্রচলন করে থাকে। এছাড়া দেশি-বিদেশি বাণিজ্যের অর্থনৈতিক লেনদেন-এ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানও ব্যাংকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

ব্যাংকে কাজের ক্ষেত্র

আধুনিক ব্যাংকে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে প্রধানত চারটি শাখা আছে । শাখাগুলোর কার্যপরিধি সংক্ষেপে এখানে উপস্থাপন করা হলো :

১. অপারেশন শাখা: সাধারণত এই শাখা আর্থিক প্রশাসন বিভাগ, অবকাঠামো বিভাগ, সফটওয়্যার বিভাগ, বিভিন্ন শাখা তদারকি বিভাগ, মানব সম্পদ বিভাগ,এবং মার্কেটিং বিভাগের কাজ সম্পাদন করে থাকে।

২. ইনভেস্টমেন্ট শাখা: ব্যাংকের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ভোক্তা বিভাগ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বিনিয়োগ নীতি ও পরিকল্পনা বিভাগ এবং মনিটরিং বিভাগের কাজ এই শাখা সম্পাদন করে থাকে।

৩. ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং শাখার: এই শাখার উল্লেখযোগ্য বিভাগগুলো হলো বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালনা বিভাগ, গার্মেন্টস বিভাগ, রাজস্ব তহবিল ব্যবস্থাপনা বিভাগ এবং বৈদেশিক রেমিট্যান্স বিভাগ।

৪. ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স শাখা: সাধারণত মনিটরিং বিভাগ, কমপ্লায়েন্স বিভাগ এবং অডিট ও তত্ত্বাবধান বিভাগের মাধ্যমে এই শাখার কাজ সম্পাদন করা হয়ে থাকে।

পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্নের ধরন

বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে ব্যাংকভেদে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও প্রশ্নের ধরণ প্রায় একই হয়ে থাকে। তবে নিয়োগদাতাদের ওপরও প্রশ্নের ধরন নির্ভর করে। নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত অথবা মৌখিক বা দুই ধরনের পরীক্ষাই হয়। লিখিত পরীক্ষায় নির্বাচিত প্রার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন।

লিখিত পরীক্ষা

সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কিছুটা ভিন্নতা থাকে। সাধারণত ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) বা এ ধরনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র বাংলায় বা ইংরেজিতে হয়। প্রশ্নপত্র সাধারণত দুটি অংশে ভাগ করা হয়ে থাকে। প্রথম অংশ নৈর্ব্যক্তিক এবং দ্বিতীয় অংশ রচনামূলক হয়ে থাকে। পরীক্ষার সময় এক থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। নৈর্ব্যক্তিক অংশের প্রশ্ন হয় সাধারণত বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান, কম্পিউটার, Analytical ability, Puzzles এবং Data Sufficiency থেকে। আর লিখিত বা বর্ণনামূলক পরীক্ষায় প্রশ্ন থাকে গণিত, ইংরেজি ও এনালিটিকাল এবিলিটি থেকে। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর প্রশ্ন একটু অন্য ধাঁচের হয়ে থাকে। প্রশ্নে উল্লিখিত বিষয় ছাড়াও ইসলামী সংস্কৃতি ও অর্থব্যবস্থার ওপর বেশ কিছু প্রশ্ন থাকে। সরকারি এবং ইসলামী ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকের প্রশ্ন করা হয় সাধারণত ইংরেজিতে। পরীক্ষার সময় এবং নাম্বার বন্টণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংকের মধ্যে ভিন্নতা দেখা যায়।

মৌখিক পরীক্ষা

ব্যাংকে লোক নিয়োগ পরীক্ষার একটি উল্ল্যেখ্যযোগ্য অংশ হচ্ছে ‘মৌখিক পরীক্ষা’। আনুমানিক ১৫ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার উপর ভিত্তি করে সাধারণত একজন নিয়োগদাতা প্রার্থীর বিচার বিশ্লেষণ ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি, যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা যাচাই করে থাকেন। মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিতদের মধ্যে প্রার্থীদের চৌকস দিকটির উপর নিয়োগদাতা মূলত জোর দিয়ে থাকেন। তার পাশাপাশি প্রার্থী যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন সে বিষয়েও তাকে প্রশ্ন করা হতে পারে। বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, দেশের মুদ্রানীতি, পুঁজিবাজার, চলমান অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশের বাজেট, কৃষি ইত্যাদি বিষয়েও চাকুরিপ্রার্থীর কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়। তাছাড়া ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক পরিভাষাসমূহ প্রার্থীকে জানতে হবে ভালোভাবে। এ সকল বিষয়ের উপর বাজারে অনেক বই রয়েছে যা প্রার্থীর প্রস্তুতির জন্য সহায়ক হতে পারে।

যেভাবে প্রস্তুতি নিবেন

বানিজ্যে স্নাতকদের জন্য:

ব্যবসায় প্রশাসন হতে স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রী অর্জনকারীদের জন্য ব্যাংকিং ক্যারিয়ার খুব আকর্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে, যদি কিনা সঠিক সময়ে সঠিক প্রস্তুতিটি একজন শিক্ষার্থী নিতে পারে। এন্ট্রি লেভেলের যেকোনো পদের জন্যই একজন ব্যবসায় অনুষদ থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীর জন্য নিয়োগ পরীক্ষার দরজা খোলা থাকে। তবে আজকের এই তুমুল প্রতিযোগীতামূলক চাকুরীর বাজারে একজন পরীক্ষার্থীকে নিজের স্বপ্নের ব্যাংকিং পেশায় নিয়োগ পাওয়ার জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়োপযোগী প্রস্তুতি।যেহেতু ব্যাংকে নিয়োগের পরীক্ষা পদ্ধতি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের জন্য প্রায় একইরকম হয়ে থাকে, পরীক্ষার্থী কে আলাদা সিলেবাস তেমন একটা অনুসরণ করতে হয় না। নৈর্ব্যক্তিক এবং লিখিত পরীক্ষার জন্য সাম্প্রতিক বিষয়গুলোকে ভালোভাবে আয়ত্তে আনতে হবে।মৌখিক পরীক্ষার জন্যও নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে। মৌখিক পরীক্ষায় যেহেতু বিশ্লেষণ ক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি, যোগাযোগ দক্ষতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা যাচাই করে থাকে, তাই পরীক্ষার্থীকে এ সকল বিষয়ে আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করে রাখতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো পরীক্ষার্থীর ব্যাংকিং পেশায় দীর্ঘ সময় থাকার ইচ্ছে আছে কিনা সে বিষয়টিও মৌখিক পরীক্ষায় যাচাই করে থাকে। তাই একজন পরীক্ষার্থীকে যথেষ্ট একাগ্রতা নিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে হবে।

বানিজ্য ছাড়া অনান্য বিষয়ে স্নাতকদের জন্য:

ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ পরীক্ষার জন্য বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের মতোই বিজ্ঞান, মানবিক ও অন্যান্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রস্তুতি নিতে হবে। অর্থাৎ ইংরেজী, বাংলা, গণিত, ইত্যাদি বিষয় গুলোর উপর দক্ষতা অর্জন করে নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাংকের বিভিন্ন সাধারণ কর্মকান্ড ও পরিভাষার উপর জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

উপসংহার

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ব্যাংকিং পেশা যদিও খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তারপরও সিদ্ধান্তটি আপনাকেই নিতে হবে যে, ব্যাংকিং পেশার জন্য আপনি বা আপনার জন্য ব্যাংকিং পেশাটি উপযুক্ত কিনা। চৌকস বেতন-ভাতাদি বা অন্যের দেখাদেখি আপনাকেও করতে হবে- তা ভেবে যদি আপনি ব্যাংকিং পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে অগ্রসর হন, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনি ভুল করবেন। কারণ, যেকোন কাজে অগ্রসর হওয়ার জন্য নিজের ‘ইচ্ছা’ এবং ‘যোগ্যতা’-কে বিবেচনা করে অগ্রসর হওয়া উচিত। তাই কেউ ব্যাংকিং পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে তাকে অবশ্যই এই পেশাটিকে নিয়ে প্রাথমিক কিছু বিশ্লেষণ করতে হবে।