রংপুর-৬ আসনে শেখ হাসিনা, শিরীন শারমিন, না জয়
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনবার ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দুইবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন রংপুর-৬ আসনে। পীরগঞ্জ উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এ নির্বাচনী এলাকা তাই ভিভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত। একসময় জাতীয় পার্টির দুর্গও বলা হতো এ আসনকে। তবে ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এখানে নৌকার হাল ধরে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটিয়েছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় এবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকেই, না হলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রার্থী হিসেবে পেতে চাইছেন এ আসনে। তাদের কেউই এখান থেকে নির্বাচনে অংশ না নিলে স্থানীয় কোনো প্রার্থীকে নিয়ে নির্বাচনে যেতে আগ্রহী তারা। ঐক্যের কারণে অন্য কোনো দলের প্রার্থীর মনোনয়ন মেনে নিতে রাজি নন তারা। সব মিলিয়ে এ আসনে রয়েছে নৌকা ও লাঙ্গলের মধ্যে লড়াইয়ের সম্ভাবনা। দ্বন্দ্ব-বিভক্তিতে জর্জরিত বিএনপি এখানে কোনো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই বললেই চলে।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার হন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও এ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রার্থী হবেন বলে আশা করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কোনো কারণে তিনি প্রার্থী না হতে পারলে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রার্থী হবেন- এমনটাই প্রত্যাশা তাদের। কারণ, পীরগঞ্জ মানেই শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ি ও তার ছেলে জয়ের দাদার বাড়ি। তাদের কেউ প্রার্থী হলে আগামী নির্বাচনে এ আসন যেমন দখলে থাকবে, তেমনি আশপাশের নির্বাচনী আসনগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন তারা।
তবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও সম্প্রতি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে পরোক্ষভাবে এ আসন থেকে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আবার দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলেও সম্প্রতি প্রায়ই গণসংযোগ করতে এলাকায় আসছেন সাবেক সাংসদ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ।
অন্যদিকে, জাতীয় পার্টিও আসন্ন নির্বাচনে এ আসনটিকে কব্জায় নিয়ে হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে মরিয়া। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, জাতীয় পার্টিতে শক্তিশালী প্রার্থীর অভাব রয়েছে। কোনো কারণে এ আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়- দু’জনের কেউই নির্বাচন না করলে এবং নির্বাচনী ঐক্যজোট না হলে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। উপজেলার রোজবাহাপুরের সুশীল ঘোষ, রামনাথপুরের দুলাল, বাবনপুরের মজনু প্রমুখ বিকল্প হিসেবে স্থানীয় প্রার্থীর প্রতি আগ্রহ দেখিয়ে বলেন, ‘হামার পীরগঞ্জোত কি এমপি ভোট করার লোক নাই?’
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফল পর্যালোচনায় বলা যায়, এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ইউপি নির্বাচনে এখানকার ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদের ১২টিতেই আওয়ামী লীগ, দুটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে জিতেছেন দলের উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ভাতিজা তাজিমুল ইসলাম শামীম।
নির্বাচন প্রসঙ্গে এ আসনের বর্তমান সাংসদ ও স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্বাচনী এলাকায় তিনি ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী নির্বাচনে এ এলাকার মানুষ নৌকাকেই জয়ী করবে। তিনি জানান, এ আসনে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা পীরগঞ্জের সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় প্রার্থী হলে স্থানীয় ভোটারদের মতো তিনিও খুশি হবেন। কে এ আসনের হাল ধরবেন, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।
পীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তাজিমুল ইসলাম শামীম এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান রাঙ্গা বলেন, এ আসনের মনোনয়ন সম্পর্কে দলের সভাপতিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। তারপরও যদি নেত্রী কিংবা সজীব ওয়াজেদ জয় প্রার্থী হন, তা হলে এলাকার মানুষ খুশি হবে। বিকল্প হিসেবে স্পিকারকেই তারা সমর্থন করবেন। কারণ, শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তিনি এ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।
পীরগঞ্জের নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগ এখনও তেমন সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে কৌশলে নানাভাবেই মাঠে প্রচার চালাচ্ছেন রংপুর জেলা ও পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য, দু’বারের সাবেক সাংসদ (জাপা প্রার্থী হিসেবে) এবং বর্তমানে পীরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মণ্ডল। যদিও এ দুই নেতার মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ থাকায় স্থানীয় বিএনপিও দুই গ্রুপে বিভক্ত।
এ আসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি এতই দুর্বল যে সাম্প্রতিক ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় তারা স্থানীয় ১৫টি ইউপির মধ্যে মাত্র তিনটিতে প্রার্থী দিতে পেরেছিল। তবে দলটির দু’বারের সাবেক সংসদ সদস্য ও বর্তমানে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মণ্ডলের তৃণমূল পর্যায়ে ব্যক্তি ইমেজ রয়েছে। এ ইমেজ কাজে লাগিয়ে তিনি আরও একবার এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হলেও রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাকে সক্রিয় দেখা যায় না।
এ আসনে বিএনপির যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হয়, তা রংপুর জেলা ও পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে। তবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মতো ভিত্তি তিনি তৈরি করতে পারেননি।
জাতীয় পার্টির অবস্থানও এ আসনে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। উপজেলা সদর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় এ দলের বিলাসবহুল নিজস্ব কার্যালয় ‘এরশাদ ভবন’ও এখন আর আগের মতো জমজমাট নয়। মাসে একদিনও এখন এটি খোলা পাওয়া যায় না। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাপা মাত্র দুটিতে প্রার্থী দিতে পারলেও শেষ পর্যন্ত শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয় তাদের। তবে এরই মধ্যে এখানে উপজেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম যাদু ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন টানিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন। উপজেলা সদর থেকে তার বাড়ি প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হলেও তিনি বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে উপস্থিত হয়ে জাপার রাজনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে না করলে এ আসনের নির্বাচনে লাঙ্গল ও নৌকার মধ্যেই জোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম যাদু বলেন, প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে স্যার (এইচএম এরশাদ) তাকে সবুজসংকেত দিয়েছেন। সে অনুযায়ী তিনি সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার লক্ষ্য এ আসনটিকে পুনরুদ্ধার করা।
বিএনপি নেতা নূর মোহাম্মদ মণ্ডল বলেন, তিনি এ আসনে দু’বার সংসদ সদস্য ছিলেন। এলাকার উন্নয়নের স্বার্থেই তিনি আগ্রহী আবারও প্রার্থী হতে।
রংপুর জেলা ও পীরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার আশা ব্যক্ত করে বলেন, নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপিই জয়ী হবে।
সূত্র: সমকাল