জনসাধারণের সঞ্চয় ব্যাংকের এটিএম থেকে লুপাটের নানান কৌশল এঁটে কোটি টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছিলো। এর তথ্য কোন ভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অবশেষে টাকা লোপাটের ঘটনায় খতিয়ে দেখতে বেরিয়ে এলো ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার কথা।
পৃথক ঘটনায় দুই ব্যাংক কর্মকর্তা এবং এক ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রীসহ ছয়জন গ্রেফতার হয়েছেন। তারা এখন কারাগারে আছেন।
সূত্র জানায়, টাকা লুটের জন্য স্বামী-স্ত্রী মিলে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। আবার নিজেদের দোষ এড়াতে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে ভুয়া তালাকনামা তৈরির ঘটনাও ঘটেছে। ব্যাংক লুটের টাকায় মানবপাচার সিন্ডিকেটও গড়ে তোলা হয়েছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এটিএমের ইলেকট্রনিক জার্নাল পরিবর্তন করে দুই কোটি ৫৭ লাখ এক হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৫ জুন চারজনকে গ্রেফতার করে ডিবি। তারা হলেন-ব্যাংক এটিএম মনিটরিং রোস্টার টিমের সিনিয়র অফিসার শাহারুজ্জামান ওরফে রনির (বর্তমানে পলাতক) স্ত্রী সায়মা আক্তার, রনি ও সায়মার সহযোগী আল আমিন বাবু, মেহেদী হাসান ওরফে মামুন এবং আসাদুজ্জামান আসাদ। এ ছাড়া ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখার ভল্ট থেকে প্রায় চার কোটি টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে বংশাল থানা পুলিশ। তারা হলেন-ব্যাংকটির সিনিয়র অফিসার ক্যাশ ইনচার্জ রিয়াজুল হক ও ম্যানেজার অপারেশন এমরান আহমেদ। শনিবার দুদকের সহকারী পরিচালক আতিকুল ইসলাম বাদী হয়ে তাদের নামে মামলা করেছেন। গ্রেফতাররা সবাই টাকা লুটের সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, এটিএম বুথ থেকে টাকা গায়েবের ঘটনায় রিমান্ড শেষে রোববার চারজনকে আদালতে হাজির করা হয়। তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন। পরে যেকোনো দিন আদালত তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করবেন।
বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কৌশলের বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার জানান, গ্রেফতার আসাদুজ্জামান আসাদ বিসমিল্লাহ বিডি এন্টারপ্রাইজ নামে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্টশিপ নেয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্যালারি অ্যাকাউন্ট করার কথা বলে তাদের বিভিন্ন ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে অ্যাকাউন্ট ও এটিএম কার্ড তৈরির জন্য ব্যাংকে আবেদন করে। এটিএম কার্ড তৈরি হওয়ার পর আসাদ সেসব গ্রহণ করে। ওই কার্ডগুলো গ্রাহকদের কাছে না দিয়ে আল আমিন বাবুর কাছে হস্তান্তর করে। আল আমিন বাবু সংগৃহীত কার্ডগুলোতে ১০-২০ হাজার টাকা করে জমা করে। পরে বাবু ওই টাকা এটিএম থেকে তোলার সময় ডিবিবিএলের আইটি অফিসার শাহারুজ্জামান ওরফে রনির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। টাকা উত্তোলনের সময় এটিএম বুথ কর্তৃক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে যে জার্নাল সৃষ্টি হয় তা সংরক্ষণ সার্ভারে যাওয়ার আগে রনি সেটি পরিবর্তন করে দেন। টাকা উত্তোলনের আগমুহূর্তে জার্নাল সংরক্ষণ সার্ভারের সঙ্গে ইএসকিউ এটিএম মনিটরিং সফটওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ কারণে এটিএম বুথের টাকা উত্তোলনের সময় যে জার্নাল সৃষ্টি হয় তা সার্ভারে জমা হয় না। রনি ‘সাকসেসফুল’ মেসেজকে ‘আনসাকসেসফুল’ মেসেজে রূপান্তরিত করার কারণে মেসেজ জার্নাল সার্ভারে গেলেও তা আর সাকসেসফুল মেসেজ হিসাবে গণ্য হয় না। বুথ থেকে টাকা উত্তোলিত হওয়ার পরও মেসেজ আনসাকসেসফুল দেখায়।
ডিবির এডিসি মনিরুল ইসলাম জানান, আনসাকসেসফুল মেসেজ দেখার পর বাবু পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হটলাইনে ফোন করে অভিযোগ করেন যে, তিনি এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের সময় তার ব্যালেন্স কেটে নিয়েছে। কিন্তু টাকা হাতে পাননি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দায়িত্বরত অফিসার অভিযোগের সত্যতা যাচাই করেন। ব্যাংকের অফিসার যখন দেখেন যে, টাকা উত্তোলনের জন্য কার্ডটি এটিএম বুথে প্রবেশ করানো হয়েছিল কিন্তু জার্নালটি ‘আনসাকসেসফুল’ তখন অফিসার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স সমন্বয় করে দেন। এভাবে চক্রের সদস্যরা ৬৩৭টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১৩৬৩টি লেনদেন করিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
বংশাল থানার ওসি আবুল খায়ের জানান, বৃহস্পতিবার ঢাকা ব্যাংকের ওই শাখায় অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি ভল্টের টাকার হিসাব মেলাতে গিয়ে তিন কোটি ৭৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকার গরমিল পায়। পরে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দুই কর্মকর্তাকে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই কর্মকর্তা টাকা আত্মসাতের কথা স্বীকার করেছে। গত বছরের ২০ জুন থেকে চলতি বছরের ১৬ জুন পর্যন্ত ওই টাকা অল্প অল্প করে সরানো হয়েছে বলে গ্রেফতাররা জানিয়েছেন।